নেদারল্যান্ডসে ‘চিংড়ির উৎপাদন, বিপণন গবেষণা ও বাণিজ্যিক বিনিময়’ (Shrimp Technology: How Bangladesh can be benefitted through Cutting-edge Dutch Technology) শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশটির বাংলাদেশ দূতাবাস গত বুধবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) দ্য হেগে দূতাবাসের সম্মেলনকক্ষে এই সেমিনার আয়োজন করে। এতে দেশটির বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রাইসুল আলম মণ্ডলের নেতৃত্বে সফররত সরকারি ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিদলসহ ৪০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে।

সেমিনার আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল টেকসই অ্যাকুয়া কালচার পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিংড়ি চাষ খাতের উন্নয়ন ও একই সঙ্গে নেদারল্যান্ডস তথা ইউরোপের বাজারে চিংড়িজাত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ। সেমিনারে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সাইয়িদ মো. রাশেদুল হক পৃথিবী বিখ্যাত বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি (Black Tiger Shrimp of Bangladesh) শীর্ষক একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ডাচ বিশেষজ্ঞ যেমন ওয়াখেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোয়েল বসমা, ওক্টোফ্রস্টের বাণিজ্যিক পরিচালক মারসেল ক্লোয়েসমায়ার, স্ক্রেটিং-এর পরিচালক আরিয়েন রোয়েম এবং হেনড্রিকস জেনেটিকসের পরিচালক রবার্ট ব্লঙ্ক প্রমুখেরা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর উপস্থাপনা তুলে ধরেন। বিষয়গুলো হলো; সুন্দরবনে উপযোগী চিংড়ি চাষ, উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চিংড়ি শিল্পের গুণগত মানোন্নয়ন, চিংড়ি উৎপাদনে মানসম্পন্ন খাবারের গুরুত্ব ও খাবার ব্যবস্থাপনা এবং চিংড়ির জেনেটিকস উন্নয়ন সংক্রান্ত সর্বশেষ অবস্থা ইত্যাদি।

সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

২৫ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে চিংড়ি চাষ ও অ্যাকুয়া কালচার পদ্ধতির আরও উন্নয়নের নিমিত্তে এ খাতে নেদারল্যান্ডসের অর্জিত জ্ঞান ও উদ্ভাবনাময় প্রযুক্তি আহরণের লক্ষ্যে বর্তমানে ছয় দিনের সফরে নেদারল্যান্ডস রয়েছে। ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি চাষে টেকসই উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণ ও এই চিংড়ি রপ্তানির বাজার খোঁজাই প্রতিনিধিদলের সফরের মূল লক্ষ্য।

উল্লেখ্য, ইউরোপিয়ান দেশগুলো বাংলাদেশের ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির প্রধান আমদানিকারক। যার মধ্যে নেদারল্যান্ডস মূল্য (৮৯.৮২ মিলিয়ন ডলার) ও পরিমাণের দিক থেকে প্রথম। ডাচ প্রতিষ্ঠান সলিডারিড নেটওয়ার্ক এশিয়া, সিফুড ট্রেড ইন্টেলিজেন্স পোর্টাল ও নেদারল্যান্ডস এন্টারপ্রাইজ এজেন্সি (RVO) যৌথভাবে এ সফরের আয়োজন করে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের উৎপাদক ও রপ্তানিকারকেরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ চিংড়ি আমদানিকারকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছে।

ইইউর বাজারে বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল নেদারল্যান্ডসের উত্রেক, দ্য হেগ ও আমস্টারডাম শহরে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও জার্মানির শীর্ষ প্রায় ৬০টি চিংড়িজাত পণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দিনব্যাপী ব্রেনস্টর্মিং সেশনে অংশগ্রহণ করে। তারা সকলেই একমত হন অরগানিক চাষাবাদের কারণে ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ি তাদের প্রথম পছন্দ। তারা অভিমত ব্যক্ত করেন, ইউরোপের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির আরও উন্নয়নে বাংলাদেশের আরও অধিক বিনিয়োগ প্রয়োজন।

সেমিনার শেষে দূতাবাসের সম্মেলনকক্ষে স্বাক্ষরিত হয়

এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের চিংড়ি চাষ খাতের আরও উন্নয়নের নিমিত্তে জ্ঞান ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তি বিনিময়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ চিংড়ি ও মৎস্য ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মাহমুদুল হক ও নেদারল্যান্ডসের হেনড্রিকস জেনেটিকস বিভির নির্বাহী পরিচালক নেইল ম্যানচেস্টারের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারক সেমিনার শেষে দূতাবাসের সম্মেলন কক্ষে স্বাক্ষরিত হয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শ্রিম্প ও ফিশ ফাউন্ডেশন ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির টেকসই উন্নয়নে কাজ করা একটি শীর্ষস্থানীয় বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান, অপরদিকে হেনড্রিকস জেনেটিকস আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যাদের শাখা অফিস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে।

চাষাবাদ প্রক্রিয়া প্রায় অরগানিক হওয়ায় ইউরোপিয়ান বিভিন্ন চেইন দোকানসমূহ ও রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশের ব্ল্যাক টাইগার চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রাইসুল আলম মণ্ডল সেমিনারে অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। বিশেষ করে ধন্যবাদ জানান হেনড্রিকস জেনেটিকসকে বাংলাদেশে তাদের কাজ করার আগ্রহের জন্য। তিনি ডাচ ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমির সুবিধা গ্রহণের আহ্বান জানান, যা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি।

সেমিনার শেষে দূতাবাসের সম্মেলনকক্ষে স্বাক্ষরিত হয়

হেনড্রিকস জেনেটিকসের সিইও থাইজ হেনড্রিকস উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত ত্রি-সমন্বয় মডেল (Triple Helix) -যেমন ব্যবসায়ী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারের সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করা, অনুসরণ ও ব্যবহারিক প্রয়োগের আহ্বান জানান।

সমাপনী বক্তব্যে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মুহম্মদ বেলাল বাংলাদেশে কাজ করার আগ্রহের জন্য ডাচ প্রতিষ্ঠানসমূহকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ডাচ দর্শন—কম দিয়ে বেশি করা (doing more with less) প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিংড়ি চাষ খাত গুণগত, পরিমাণগত ও টেকসই উৎপাদনে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি ইউরোপে প্রায় ‘অরগানিক’ খাবারের গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে এই আশাবাদ ব্যক্ত করে রাষ্ট্রদূত বেলাল টেকসই প্রযুক্তি ও জনবান্ধব নীতির সমন্বয়ের মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের বাগদা (Black Tiger) চিংড়িকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে উন্নয়নের আহ্বান জানান।

সেমিনার শেষে উপস্থিত সকল অতিথিকে বিখ্যাত বাগদা চিংড়ির দোপিঁয়াজা সহকারে নৈশভোজে আপ্যায়িত করা হয়।

Collected:

https://www.prothomalo.com/durporobash/article/1581766

LEAVE A REPLY